বানান ভুলের কারণে কত যে কাণ্ড ঘটতে পারে তা বলাই বাহুল্য। রাস্তাঘাটে হাঁটতে গেলে না চাওয়া সত্ত্বেও আমার চোখ আটকায় নানান প্রকার বানান ভুলের দিকে। সব ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টারে বানান ভুলের ছড়াছড়ি আর সেসব ভুল কেবল আমার নজরেই কেন পড়ে তাও বুঝে আসেনা। এজন্য ময়মনিসংহে থাকতে যখন বাইরে বেরুতাম তখন বন্ধুবান্ধব আমাকে উপরে তাকাতে নিষেধ করত, তাদের বইখাতাও আমার কাছ থেকে সাবধানে রাখত পাছে যদি ভুল ধরে বসি! যাইহোক, বাহাদুর ছিল উল্টা, সে কিছু লিখেই আমার কাছে চলে আসত মাগনা দরে প্রুফ সংশোধনের জন্য। এমন না যে আমি সবজান্তা শমসের, আমার বানান ভুল হয় না কিংবা আমার চেয়ে ভালো প্রুফচেকার বাছাধন আর কেউ নাই। হিসাবটা বরং উল্টা, আমি পেশাদার প্রুফচেকার নই, শৌখিন প্রুফ সংশোধক। তো এসব ছাইপাশ ভাবত ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের কথা, আমাদের বাংলা ব্যাকরণের বইয়ের শেষ এক পাতায় নাকি ভেতরের এক পাতায় মনে নাই তবে মনে আছে যে তাতে কিছু হিজিবিজি চিহ্ন দিয়ে প্রুফ সংশোধনের একটা হালকা পাতলা জ্ঞান দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেছিলো পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। বৃথা বলার কারণ ওই পাঠ আমাদের এসএসসির সিলেবাসে ছিল না আর সেকারণে পড়াও হয় নি কারুর। তবে মিনিট কয়েক সে কিম্ভূতকিমাকার চিহ্নাদির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম এবং মনে হয়েছিল যে এতকিছু চিহ্নটিহ্ন না দিয়ে সবকিছু লিখে দিলেই হতো যে কোন জায়গায় কী সমস্যা হয়েছে।
আধুনিক সময়ে অবশ্য কথাটা মিথ্যা না। পরে যখন কম্পিউটারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল বুঝলাম এইখানে ডিজিটাল প্রুফ চেকারের অস্তিত্ব আছে। লে অবস্থা! প্রুফচেকের ভবিষ্যৎ তাহলে ফকফকা। সেটা যন্ত্রপাতি করে দিলে মানুষের আর কাজ কি! এখন তো পাণ্ডুলিপিও ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে লেখা হয়, তাতে বাংলা প্রুফ চেকেরও সুবিধা আছে। যাক্গে একজন প্রুফ সংশোধকের কী করা উচিত বা অনুচিত সূত্রাকারে তার একটা ফিরিস্তি দিচ্ছি-
- বানানের সমতা রক্ষা করা জরুরি। একই শব্দের নানান রকমের বানান লেখা অনুচিত। এই যেমন- বাংলা একাডেমীর গোরু আর আমজনতার গরু দুটোকে এক মাঠে চরানো চলবে না। একডেমীর গোরু লিখতে চাইলে সব জায়গায় একাডেমিক গোরু আর আমজনতার গরু লিখতে চাইলে আমজনতার গরুই লিখবেন। মিলমিশের সুযোগ নাই।
- লেখকের পাণ্ডুলিপিতে ভুল থাকলেও তা সংশোধন করার দায়িত্ব প্রুফ সংশোধকের উপরই বর্তায়। লেখক মানে তিনি লিখতে পারেন, তাই বলে তারা বানানে ভুল করতে পারেন না এমন না। তাদের জন্য বানান করার অনুমতি রয়েছে। আপনার কাজ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়েছে (:
- ভুল বিরামচিহ্ন থাকলে অথবা কোন বিরামচিহ্ন বাদ পড়ে গেলে আপনাকে তা সংশোধন করে দিতে হবে। “এখানে প্রসাব করবেন, না করলে জরিমানা শিরোধার্য” করার কৌতুকটা তো জানেনই, কথা বাড়ালাম ন বিষয়ে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল লেখক সত্যিই প্রস্রাব করার জন্য বলে থাকলে আপনি নিষেধ করতে পারেন না।
- মূল বিষয়ের কিছু অংশ বাদ পড়ে গেলে তা যথাযথ চিহ্ন দ্বারা দেখানোর দায়িত্ব আপনার। তবে গল্পের ভেতরে গল্প ঢুকাইতে যাইয়েন না। ধরা পরলে কেস খাইয়া যাবেন। শুধু বিষয় না, অনেক সময় একটি শব্দের অংশ বিশেষও বাদ পড়ে যায়। “পুলিশের গুলি খেয়ে বদির মৃত্যু” বাক্যে গুলির লি ছুটে গেলে কাণ্ডটা কী আন্দাজ করেন।
- *অতিরিক্ত শব্দ থাকলে তা সরিয়ে দিতে নির্দেশ দিবেন। অতিরিক্ত শব্দ বলতে অপ্রয়োজনীয় শব্দ বা একই শব্দ হুদাই দুইবার ব্যবহার করছে আরকি। একই বাক্যও ভুল করে দু’বার কম্পোজ হয়ে থাকতে পারে।
- উল্টে যাওয়া অক্ষর সম্পর্কে একটু বেশিই খেয়াল রাখবেন। গুলি খাওয়ার মত এই ঘটনাও মারাত্মক রকমের হতে পারে। “অমুকের ছাপায় ভুল ছিল” কথাটার ছাপা অংশটাকে একটু উল্টেপাল্টে দেখতে পা সবসময় যে ছাপা-পাছা ধরণের উল্টা থাকবে এমন না। W উল্টে Mও হয়ে যেতে পারে।
- দুটি শব্দের মধ্যে নির্দিষ্ট ফাঁক না থাকলে অর্থাৎ ফাঁক বড় হয়ে গেলে কিংবা ঘেষাঘেষি হয়ে গেলে সে সম্বন্ধে সতর্ক থাকতে হবে।
- অনেক সময় শব্দ বা বাক্যের সাদৃশ্য হেতু অসতর্কবশত এক লাইন থেকে দু’ এক লাইন পরের বাক্য কম্পোজ করা হয়। সেসব ক্ষেত্রে প্রুফ রিডারকে প্রতীক চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়।
- টাইপের ক্ষেত্রে কম্পোজ করার সময় ভুল হতে পারে। বিশেষ করে ইংরেজি টাইপের ক্ষেত্রে স্মলের পরিবর্তে ক্যাপিটাল এবং ঠিক এর উল্টোটাও হতে পারে। এসব দেখার দায়িত্বও প্রুফ-রিডারের।
- ভাঙা টাইপ বদলানোর নির্দেশ দিতে হবে। অনেক সময় ফন্টের সমস্যা থাকে, যেমন হিন্দ শিলিগুড়ির সব ঠিক থাকলেও ১ এ সমস্যা আছে। প্রয়োজনে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলতে পারেন।
- ট্যাব বা ইন্ডেটেশন ঠিক রাখার দিকে নজর দিতে হবে। সোজা বাংলায় অসমান লাইন সোজা করার নির্দেশ দিতে হবে।
- মার্জিনের জন্য প্রয়োজনীয় ছাড় দেওয়া হয়েছে কিনা দেখতে হবে। তবে আমার ছোট চাচির পোলাপানের লেখা সংশোধন করতে গেলে চারপাশে কোন মার্জিন রাখা যাবে না। এতে কাগজের কী পরিমান অপচয় হ উনার কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। উনি সবচেয়ে বেশ কষ্ট পান উনার মেয়ে যখন ভাগের সাহায্যে লসাগু নির্ চেষ্টা করে।
- লাইন হাইট বা উপরের লাইনের সঙ্গে নিচের লাইনের কি সে ঠিক আছে কিনা তাও দেখার দায় আপনার।
- পৃষ্ঠা সংখ্যার ক্রম ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে।
- অনেক সময় কোটেশনে ভুল থাকতে পারে। কোটেশনের একদিকে দ্বিত্ব উদ্ধৃতি চিহ্ন, অন্য একক উদ্ধৃতি-চিহ্ন অথবা একদিকের চিহ্ন বাদ পড়ে যায়। এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
- অসমান অক্ষর সমান করার নির্দেশ দেওয়ার দায়িত্ব সম্পর্কেও সজাগ থাকতে হবে।
- ইটালিক, সাবস্ক্রিপ্ট, সুপারস্ক্রিপ্ট, বোল্ড বা মোটা হরফ ইত্যাদি ঠিকঠাক আছে কিনা তা লক্ষ্য করতে হবে।
- সবশেষ কথা, আধুনিক যুগে কিছু চ্যাংরা লেখক বের হয়েছে, এরা ই আর য় এর পার্থক্য না জানলেও বই লিখতে দৌঁড়ে আসে। এগুলোর জন্য ই-ত্ব বিধান আর য়-ত্ব বিধানের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন।
- আচ্ছা, আরেকটা কথা; রাবা খানের বান্ধobi বইয়ের মত বাংরেজিতে লিখিত বইয়ের প্রুফ সংশোধন করতে চাইলে উপরের সব নিয়ম ভুলে যান। গুগলে murad takla jukti dia bal লিখে সার্চ করুন, বাকিটা শিখিয়ে দিবে।