স্পেসিসিজম বা প্রজাতি বৈষম্য

Animal rights পড়তে সময় লাগবে: 5 মিনিট প্রকাশের তারিখ: আগস্ট 31, 2022

বৈষম্যের নানা ধরনই তো হতে পারে। শৈশব থেকেই দেখে আসছি আর শুনে আসছি কতশত বৈষম্যের ফিরিস্তি। এসবের কোনোটারই অবশ্য কোনো সমাপ্তি দেখিনি। লিঙ্গ বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য, বর্ণগত বৈষম্য; বৈষম্যের হরেক রকম কদলি। এদিক থেকে পৃথিবীটাকে বৈষম্যের আঁতুড়ঘর বললেও তা অত্যুক্তি হবে না। আমরা সবাই বৈষম্য করছি আবার সবাই বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। সেসব পারস্পরিক বৈষম্যের কথা নাহয় আজকের মতো তুলেই রাখলেন। যে বৈষম্যের কথা আপনার মাথায় কখনো আসেনি চলেন সেটা নিয়েই একটু আলাপ করি। সম্ভবত প্রজাতিগত বৈষম্যই এমন ধারার বৈষম্য যা আপনি ভাবেন নি, এই খেজুড়ে আলাপের পরেও ভাববেন না এবং সবচেয়ে এটি কোনো মিউচুয়াল তথবা পারস্পরিক বৈষম্য নয়! এখানে বৈষম্যের শিকারেরা অংশ বৈষম্য নিয়েও কোনো ধারণা রাখে না। তারা কারা? অবলা প্রাণী! শুধু অবলা নয়, সবলারাও তার স্বীকার! প্রাণীদের প্রতি দরদ ঢালতে ঢালতে দরদশূন্যতায় ভুগছেন এরকম ব্যক্তিকেও আমি এ বৈষম্যের হর্তাকর্তার আসনে দেখেছি।

পশুপাখির সাথে আমাদের সম্পর্কটা খুব সহজ সরল না, বেশ জটিলই বলা যায়। আমরা কিছু প্রাণীর সাথে খুব সদয় আচরণ করি, তাদেরকে পোষা প্রাণী হিসাবে রাখি, তাদের নাম দিই, এবং এমনকি অসুস্থ হলে তাদেরকে ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত নিয়ে যাই। আবার বিপরীতে একই আমরা অন্য কোনো প্রাণীর গলায় ছুরি ধরছি, তাদের মাংস দিয়ে রেজালা বানাচ্ছি, ব্যবসা করছি তাদের চাল চামড়া পালক নিয়েও। বিজ্ঞানের চাকচিক্য বাড়াতে ল্যাবরেটরিতেও তাদের প্রাণ হরণ করি। চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক কিংবা আরও অনেক মাধ্যমে তাদেরকে বানাচ্ছি বিনোদনের উৎস। আবার এমনও ঘটনা আছে যে বেহুদাই কোনো কারণ ছাড়াই চড়াও হচ্ছি কোনো কোনো প্রাণীর উপর। এই কদিন আগেই এক কুকুরের ছিন্নভিন্ন মাথা দেখেই অবাক হয়ে গেছি। মাথার তালুর উপরের অংশ প্রায় খোলা, কোনো চামড়া নেই। কোনো কসাইয়ের দোকানে হয়ত উঁকি মেরেছিলো আর কসাই পেয়েছিলো তার হাতের কাজের পরিপক্বতা দেখানোর এক অনবদ্য সুযোগ। মাছি ভনভন করছে এই খোলা অংশে, তারপরও সে কোনো রকম চিকিৎসা ছাড়াই দিব্যি লড়াই করছে। এই লড়াইটা কার সঙ্গে? নিজের জীবনের সঙ্গে? নাকি সাক্ষাৎ মরণের সঙ্গে? এমনও কি হতে পারে যে লড়াইটা ওই কসাইয়ের সঙ্গে? না! আমি ভেবে কিছু ঠিক করতে পারিনি তখন। তবে দাঁড়িয়ে থেকে এতটুকু ভাবতে পেরেছিলাম যে এরকম সহ্যশক্তি আমারও থাকলে মন্দ হতো না! আচ্ছা তখন কী আমারও এরকম কোপ খেতে হতো? আমিও কি হতাম ওই কসাইয়ের চিত্রকলার ক্যানভাস?

প্রজাতিগত্য বৈষম্য বা প্রজাতিবাদের সাথে সংস্কৃতি, ধর্ম, আইন সহ অনেক কিছুর হিসাব নিকাশ জড়িত। কুকুরপ্রেমী ব্যক্তির তেমন কিছু আসে যায় না রাস্তায় পড়ে থাকা শিয়ালের মরদেহ দেখে। সাপের মাথা থেঁতলে আনন্দ পেতে ভুল করেন না কোনো বিড়ালপ্রেমীও, কিন্তু এতে স্বভাবতই আহত হবেন কোনো কোনো সর্পপ্রেমী। এই যে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ সেটিও স্পেসিসিজমকে প্রভাবিত করছে।

ধর্মবিশ্বাসও স্পেসিসিজমের আরেক প্রভাবক। যেমন একজন মুসলিমের কাছে কুকুরের চাইতে শূকরের জীবন তুচ্ছ, বিপরীতে একজন খ্রিস্টানের কাছে গরুর চেয়ে শূকরের মূল্য অধিক, আবার একজন হিন্দুর কাছে ছাগলের চেয়ে গরুর জীবনের মূল্য অনকে বেশি। শুকরের প্রতি তীব্র যে ঘৃণা আমি বাঙালি মুসলিম সমাজে দেখে বড় হয়েছি তা রীতিমত অকল্পনীয়। আমার এলাকায় শুকরের স্থানীয় নাম হৌর্। কিন্তু শুকর কিংবা হৌর্ কোনোটাই মুখে না নিতে এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এখানে রয়েছে। শুকরের নাম মুখে আনলে পাপ হবে ভেবে তারা বিকল্প নাম গীদর খুঁজে নিয়েছে! কিন্তু বিকল্প নামে কী পাপ কম হবে কিনা তার হিসাব কি কেউ করেছে? এলাকায় মাঝেমধ্যেই শুকরের পাল নিয়ে যাযাবর সম্প্রদায় আসতো। সাধারণত গ্রামের বিভিন্ন জঙ্গল, কচুগড় এসব জায়গায় এদের চরানো হত। আর কী পাশবিক আনন্দের হোলিখেলা আমি দেখতাম, এলাকার ছেলেপিলে থেকে শুরু করে বুড়োরা পর্যন্ত লাঠিসোটা নিয়ে আসতো এসব শূকরকে বেধড়ক পেটানোর জন্য। পালের সঙ্গে আসা ছেলেদের মুখে আমি কোনো প্রতিবাদের ভঙ্গি দেখতাম না। মাঝেমধ্যে হালকা যে দরদের ছিঁটেফোটা দেখতাম সেটাও বাণিজ্যিক সহানুভূতি; পাছে না আবার তার শূকরের কিছু হয়! আমার হাই স্কুলের পিছনেই ছিলো এদের ক্যাম্প দিনভর এসব কীর্তি নজরে আসতো আমার।

লাভ বা ক্ষতির সঙ্গেও স্পেসিসিজম জড়িত। ফসল থেকে কাঁথা বালিশ সবকিছু কেটেকুটে শিল্পকলার কাজটি বিনা পারিশ্রমিকে করা অনাকাঙ্ক্ষিত মজদুর ইঁদুরের চেয়েও লোমশ বিড়ালের কদর অবশ্যই বেশি তা সে যেমনই হোক না কেন। “কিউট” বলে একটা বিড়ালছানাকে কোলে নিতে দ্বিধাবোধ করবেন ক’জন? এই ইন্টারনেট যুগে যতগুলো পশুপ্রেমী গ্রুপ আমি দেখেছি তাদের সমস্ত আয়োজন বিড়াল কেন্দ্রিক বা কুকুর কেন্দ্রিক। মিমের জন্য বিড়ালের রাজত্বও কেউ অস্বীকার করবেন না। মশা মারতে গিয়ে কখনো কার হাত কেঁপেছে, কখনও খারাপ লেগেছে, কখনও পিছুটান হয়েছে এমনটা অনভিপ্রেত। কিন্তু পিঁপড়ে মারার ক্ষেত্রে অনেককেই আমি দেখেছি পিপড়েকে ছেড়ে দিতে। শুকরের মতই শিয়াল দেখামাত্র পিটিয়ে মারার উন্মাদনা দর্শন আমার একদম ছোটবেলার অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন হলো, কেনো এই মারার জন্য তোড়জোড়? ক্ষতিটা কী করেছে সে? কেনো দেখামাত্রই ছুটে যেতে হবে তাকে মারার জন্য!

প্রজাতিভিত্তিক বৈষম্যের উদাহরণ

প্রাণী নিয়ে কাজ করেন বা ত্রাণ সরবরাহ করেন তারা জানেন এই বঙ্গীয় সর্বশ্রেষ্ঠ আদম বলে দাবি করা মানুষদের তিরস্কার আর খিল্লি কত প্রকার। মানুষ রেখে কেনো পশুদের প্রতি দরদ দেখানো হচ্ছে সে প্রশ্ন অনেকের কাছেই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আমি স্পেসিসিজম যেমন দেখি তেমনি এটাও নজরে পড়ে যে পশুপ্রেমীরা কেবল পশুপ্রেমী নন কিংবা তারা মানববিদ্বেষীও নন। তাহলে দুটো বিষয়কে মুখোমুখি দাঁড় করানোর কোনো অর্থ হয় না। কেউ কুকুরের খাবার জোগাচ্ছেন মানে এই না যে তিনি আর্তের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না।

যাকগে দুনিয়ার সবারই সবকিছু নিয়ে ভাবার সময় নাই, ভাবতেও হবে এমন না, সব ভাবনাই সঠিক এমনও না। এত এত বৈষম্যের ভীড়ে এই বৈষম্যের হয়তো ঠাঁই হবে কদাচিৎ। সেখানে এর ভবিষ্যত কী তা আমার না জানাই স্বাভাবিক। অনেকে ভেগানদেরকে স্পেসিসিজমের হর্তাকর্তা মনে করেন সেটাও ঠিক না। কেউ ভাবেন এটা একটা হুদাহুদি ধারণা; আর দশটা বৈষম্যে ধারণার মতই অমূলক কিংবা রংচরানো। চুনোপুটি ভোজনরসিক থেকে দার্শনিক সমাজসেবক, আপাদমস্তক পশুপ্রেমীদেরও অনেকেই তা ভাবেন। তাদের ধারণাও সত্যিও তো হতে পারে! যাক‌্গে কারুর মতের উপর জোর চলে না। তবে পশুপাখিকে যেন অযথাই কষ্ট না দেন অন্তত সেই নিবেদন করছি। আবার একটু ইচ্ছ করলেই যেখানে পশুপাখিকে কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচানো যায় সেখানে অন্তত অবহেলা কাম্য নয়। যেমন হাঁসমুরগি উল্টো করে ঝুলিয়ে বহন করা কিংবা নির্ভার হেটে যাওয়া কোনো প্রাণীকে কেবল মজার ছলে মারধর করা, পুকুরে থাকা ব্যাঙের গায়ে ঢিল ছুড়ে মজা নেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক কাজগুলো অন্তত করবেন না।